জীবনের মোড়

@Admin
0


--তোর কপাল পুড়লো রে মা। তোর স্বামী ওর চাচতো বোন রে নিয়ে পালাইয়া গেছে

বিয়ের এক মাসের মাথায় রাহার স্বামী রাব্বি তার চাচাতো বোন সন্ধ্যা কে নিয়ে পালিয়ে গেছে। খবর টা শুনতেই যেনো রাহা আচমকা পাথর হয়ে গেছে। রাহার মা রাহাকে খবর টা দিয়েই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। রাহা নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে। ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে না, ১৫ বছরের সদ্য বেড়ে উঠা দূরন্ত কিশোরী হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো। সবে মাত্র ক্লাস নাইনে এ পড়ে রাহা। বড়লোক ছেলে পাওয়ায় যাচাই বাচাই না করেই বাবা-মা দুইদিনের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দিলো রাহাকে। যার ফল-স্বরুপ আজ রাহাকে এইদিন টা দেখতে হচ্ছে। রাহা নিজেকে ওর মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা রুমে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। রুমের দরজা বন্ধ করেই রাহা নিজেকে গুটিয়ে দিলো হাটুর ভাঁজে। ওর কানের মধ্যে এখনো একটাই শব্দ বাজচ্ছে....
--তোর স্বামী অন্য মাইয়া নিয়ে পালাইয়া গেছে।
রাহা শান্ত হয়ে আছে আজ। কে বলবে এই মেয়েটাই সারাদিন দূরন্তপনা করে বেড়ায়। রাহা আজ কাদছে না। ওর কান্না পাচ্ছেনা আজ। কিছু কিছু সময় আঘাতের পরিমান বেশি হলে মানুষ কাঁদেনা শান্ত হয়ে যায়। রাহা ও আজ শান্ত হয়ে গিয়েছে।
____________________________________________
--দেখো রাহা তোমার প্রতি আমার ভালো লাগাটা শুধুই ক্ষনিকের ছিলো। ক্ষনিকের মোহ-মায়ায় জড়িয়ে তোমাকে বিয়ে করে আমি ভুল করেছি। আমি সত্যিকার অর্থে সন্ধ্যাকে ভালোবাসি। সন্ধ্যার প্রতি ভালোবাসাটা আমাকে ভালো থাকতে দেয়নি এত দিন। তাই আজ বাধ্য হয়ে তোমাকে ঠকাতে হলো......
রাব্বির মুখে কথা গুলো শুনে রাহা হাসলো। আজ দুইদিন পর রাব্বি ওর সদ্য বিবাহিতা বউ সন্ধ্যাকে নিয়ে রাহার সামনে এসে হাজির হয়েছে। রাহা কোনো কথা না বলে রাব্বির দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই রাব্বি উপরোক্ত কথা গুলো বলে উঠলো। রাহার বাবা রাব্বির দিকে তেড়ে যেতেই রাহা ওর বাবাকে আটকে বলে উঠলো.....
--- বাবা আজ তোমাদের উপর আমার অনেক অভিযোগ রয়েছে। এই ছেলেটা তো আমাকে জোর করে বিয়ে করতে চায়নি। এর বাবা মা ও আমাকে জোর করেনি। শুধু পছন্দ হয়েছিলো বিধায় তোমরা লোভে পড়ে যাচাই বাছাই না করেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলে। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করোনি "যে আমি এই বিয়েতে রাজি কিনা"। আমার মতামতে কোনো গুরুত্ব দাও নি কোনোদিন। জানো মা অনেক সময় বাবা-মা সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে অজান্তেই সন্তানের ক্ষতি করে ফেলে। আজকে তোমাদের জন্য আমার পড়ালেখা বন্ধ হলো, আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেলো, নিজের স্বামী ধোকা দিলো, আমার জীবনে আর কি থাকলো মা। আর কি থাকলো বলতে পারো?
বলেই রাহা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। রাব্বি ওর নতুন বউকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। রাহা শুধু অসহায় চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। রাহার বাবা-মা ও নিঃশব্দে রাহার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আজ রাহা কাঁদছে মন উজাড় করে। আজকের পর আর রাহা কাঁদবেনা। রাহা কাঁদতে কাঁদতে বললো......
" আমার সব অভিযোগ উপর ওয়ালার কাছে দিয়ে দিলাম। একদিন ঠিক তিনি আমার ধৈর্যের পুরষ্কার দিবে"
রাহা চোখের পানি গুলো মুছে নিয়ে রুমে চলে গেলো।
____________________________________________
পরের দিন রাহা ওর বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে জোর খাটিয়ে বলে উঠলো....
---আমি পড়ালেখা করব মা। আবার সব নতুন করে শুরু করব। আমি আমার অতীত আগলে বেঁচে থাকব না। অতীত আগলে বেঁচে থাকাটা বো'কা'মি।
রাহার কথা শুনে রাহার বাবা রাহার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলো....
--আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি মা। এখন থেকে আর তোর কোনো কিছুতে বাধা দিব না। তোর পাশে সব সময় থাকব। তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি আমরা তোর পাশে আছি।
বলতেই রাহা ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। নিজের মেয়েটাকে স্বাভাবিক দেখে রাহার মা ও একটু স্বস্তি পেলো।
____________________________________________
"কয়েক বছর পর"
রাহার গাড়িটা মাঝ পথে খারাপ হয়ে যাওয়ায় রাহার মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। রাহা একটু গলা চেচিয়ে বললো....
---শাওন ভাই আজ আমার অনেক জরুরী একটা অপারেশন আছে। তুমি একটু গাড়িটা চেক করে নিবে তো।
শাওন রাহার ড্রাইভার। রাহার কথা শুনে শাওন বলে উঠলো....
--আপা আপনি একটা কাজ করেন। আমি আপনারে একটা টেক্সি ভাড়া করে দেই। আপনি চলে যান।
রাহা ও সম্মতি জানিয়ে বেড়িয়ে গেলো। ওর এখন হসপিটালে যাওয়াটা অনেক দরকার। রাহা হাত ঘড়িটায় সময় দেখতে দেখতে হসপিটালের ভেতরে ঢুকতেই কারোর সাথে ধাক্কা লাগলে রাহা লোকটার দিকে না তাকিয়ে বলে উঠলো....
---সরি সরি। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
বলেই রাহা সামনে এক পা দিতেই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো.....
---রাহা তততুমি?
নিজের নাম শুনে রাহা আচমকা পেছনে তাকিয়ে দেখলো একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে। ছেলেটার মুখটা অনেক চেনা চেনা মনে হচ্ছে রাহার। রাহা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। ছেলেটা ঠিক বুঝতে পারছে রাহা ওকে চিনতে পারেনি। ছেলেটা রাহার সামনে এগিয়ে বলে উঠলো....
---আমাকে চিনতে পারোনি বোধহয়। আমি কিন্তু তোমাকে ঠিকি চিনতে পেরেছি। তুমি এখনো সেই ১৫ বছরের সেই কিশোরীর মতোই সুন্দর আছো। একটু ও চেঞ্জ হও নি। এখনো তোমার মুখে মায়া দিয়ে ভরপুর।
এইবার আর রাহার চিনতে অসুবিধা হলোনা ছেলেটা কে? ছেলেটাকে চিনতে পেরেই রাহা মুখ ঘুরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। এত বছর নিজের প্রাক্তন স্বামীকে চোখের সামনে দেখে পুরনো ঘাঁ আবার সতেজ হয়ে উঠছে। রাব্বি কয়েকবার রাহাকে পেছন থেকে ডাক দিলেও রাহা পেছনে ফিরে তাকায়নি। রাহা চলে যেতেই রাব্বির ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। রাহা ওর কেবিনে এসে চুপ চাপ বসে পড়লো। রাহার চোখের কোনে পানি জমে আছে। হয়তো কোথাও একটা অতীত নিয়ে দূর্বলতা সবার থাকে। রাহাও অনেক চেষ্টা করেও অতীত ভুলতে পারেনি। সেদিনের পর রাহাকে সমাজে কত কথা শুনতে হয়েছে। রাহাকে রাহার বাবা-মাকে রাস্তায় বের হলেই নানা কথা শুনতে হয়েছে। তাও রাহা নিজেকে সামলে নিয়েছে। কঠিন পরিস্থিতেও নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়েছে। যার ফল স্বরুপ আজ রাহা একজন সফল গাইনী ডাক্তার। আজো রাহা কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারেনা। বিয়ে না করার পন নিয়েছে। নিজের জীবন টা অন্যকে সাহায্য করেই কাটিয়ে দিতে চায়। রাহা নিজের কেবিনে বসে পুরনো কথাই ভাবছিলো হঠাৎ করেই কারোর পায়ের শব্দ শুনে রাহা উপরে তাকাতেই রাব্বিকে দেখে পেলো। রাব্বিকে দেখেই রাহার মুখটা শক্ত হয়ে উঠলো। রাহা উঠে এসে রাব্বির সামনে দাড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো....
--আপনি? আপনি কেনো এখানে? কার পারমিশনে এই রুমে ঢুকেছেন। বেরিয়ে যান এক্ষুনি।
রাহার কথা রাব্বি রাহার পায়ের সামনে বসে পড়লো হাটু ভেঙে বসে পড়লো। রাব্বির এহেতুক কান্ডে রাহা অবাকের শেষ সীমানায়। রাব্বি রাহার সামনে বসেই বলে উঠলো.....
---সেদিন তোমাকে ঠকানোর শাস্তি উপর ওয়ালা আমাকে ঠিক দিয়েছে। সন্ধ্যাকে বিয়ে করার এক বছরের মাথায় সন্ধ্যা আমার সমস্ত সম্পত্তি টাকা পয়সা ছলে-বলে কৌশলে নিজের করে নিয়ে অন্য একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। আমি সর্বহারা হয়ে এখনো বেঁচে আছি। শুধুমাত্র তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তুমি আমাকে ক্ষমস করলে আমি ম/রে গিয়েও শান্তি পাবো। তা ছাড়া আর বেশি দিন ও আমি এই পৃথিবীতে নেই। শেষ সময়ে এসে আমাকে একটা বার ক্ষমা করে দাও প্লিজ।
রাব্বির কথা শুনে রাহার একদিকে যেমন মুখে হাসি ফুটলো অন্যদিকে রাব্বির শেষ কথা শুনে রাহার মুখের হাসি নিমিশেই উধাও হয়ে গেলো। রাহা শান্ত কন্ঠে বললো......
---আপনি শেষে কি বললেন? কি হয়েছে আপনার?
রাহার কথা শুনে রাব্বি কয়েকটা রির্পোট রাহার হাত দিলো। রাহা রির্পোট গুলো দেখে ছলছল চোখে রাব্বির দিকে তাকালো। রাব্বি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো....
"আমার আফসোস নেই। নিজের পাপের শাস্তি পেয়েছি। একটা নির্দোষ মেয়েকে ঠকানোর শাস্তি পেয়েছি। ক্ষমা করো আমাকে"
রাহা এখনো ছলছল চোখে রাব্বির যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটাই আর বেশিদিন পৃথিবীতে নেই ভাবতেই রাহার কেনো যেনো দম বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। রাব্বির ব্লাড ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ। আর মাত্র কয়েক দিন ওর হাতে সময় আছে। রাহা শক্ত কাঠ হয়ে দাড়িয়ে আছে। রাহার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস উঁকি মে''রে বলে উঠলো....
"আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না" সত্যিই জীবনের মোড় কখন কোন দিকে ঘুরে যাবে কেউ জানেনা।
সমাপ্ত
অনুগল্প
জীবনের_মোড়
[সত্য ঘটনা অবলম্বনে]
লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী



Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)