বিদায় বেলায়

@Admin
0


 ভোর হয়েছে কি হয়নি বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেছে। বাড়ির একমাত্র মেয়ে আজ শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। মেয়ের বিদায়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে সেই কখন থেকে।

তনুময় বাবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। নিচে ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটা এসে গেছে তাঁর মেয়েকে নিয়ে যাবে বলে।
বুকের ভিতরে হাজারটা অনুভূতির ঢেউ উঠছে তনুময় বাবুর। ওনার বড় আদরের মেয়ে মিছরি। নিজের সবটুকু দিয়েই মেয়েকে বড় করেছিলেন। আজ থেকে সেই মেয়েটাই নাড়ির টান বিচ্ছিন্ন করে অন্য কারোর সংসার আলো করে থাকবে।
— তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে? মিছরিরা তো এখনি বেরোবে। আশীর্বাদ করবে না ওদের?

পিছু পিছু কখন স্ত্রী রেবতী দেবী এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করেননি তনুময় বাবু।
চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠা জলটা মুছে ফেলে মৃদু হাসলেন তনুময় বাবু।
বললেন,
— চলো।
— মন খারাপ হচ্ছে বুঝি? মন খারাপ করে কি হবে বল তো? মেয়েরা যে চিরকাল বাপ মায়ের কাছে থাকে না। তাছাড়া তোমার মেয়ে তো এমনিও কাজের জন্য বাইরেই থাকে। এই বিচ্ছেদ তো আর আজকের নয়।

রেবতী দেবীর কথা শুনে তনুময় বাবু মাথা নাড়ালেন।
— না রেবতী, তা ঠিক নয়। চাকরিসূত্রে মেয়েটা বাইরে থাকে বটে, তবু এতদিন জানতাম মেয়েটা আমারই আছে। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে আমার মিছরি সম্পূর্ণরূপে অন্য কারোর হয়ে গেছে। আমার মেয়েটা আর আমার রইলো না।

বিষাদের ছোঁয়ায় তনুময় বাবুর কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে।
— এখন এসব কথার কোনো মানে আছে? আজ নাহয় কাল মেয়ের বিয়ে দিতেই হত। তাড়াতাড়ি চল, আশীর্বাদটা সেরে ফেলো। আর মিছরির সামনে অমন মুখ ভার করে থেকো না। মেয়েটা কষ্ট পাবে।

অগ্যতা রেবতী দেবীর কথা মতোই নিজেকে সামলে মেয়ে জামাইকে আশীর্বাদ করতে গেলেন তনুময় বাবু।
মিছরির মাথায় ধানদূর্বা ছোঁয়াতেই বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো তনুময় বাবুর। মনে পড়ে গেল প্রতিটি জন্মদিনে মেয়েকে এভাবেই আশীর্বাদ করেন তনুময় বাবু, আর মিছরি ঝাঁপিয়ে পড়ে ওনার কোলে। মেয়েটাকে কি আর পাবে সেভাবে? চলেই তো যাচ্ছে সে। অবশেষে বিদায়ের মুহুর্তটা চলেই এলো। মেয়ের হাত ধরে গাড়ি অব্দি এগিয়ে দিলেন তনুময় বাবু। ঠিক তখনি মিছরি ওনার হাতটা ধরলো।
— বাবাই, একটু শুনবে?

মেয়ের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েন তনুময় বাবু।
— জানো বাবাই, আমি এতদিন জানতাম আমাকে তোমার চেয়ে বেশি কেউ বোঝে না। সেই তুমি আমাকে ভুল প্রমাণিত করলে?
— মিছরি, কি বলছিস এসব?
— ঠিকই তো বলছি বাবাই। তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি?
— এসব কথা কে বললো তোকে?
— তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার চোখ পড়তে পারি। বাবা মেয়ের সম্পর্কটা বুঝি এতটাই ঠুনকো হয় যে এত সহজে ভেঙে যাবে? আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না বাবাই। আমি তো শুধু আরেকটা নতুন পরিবারের সাথে একটা নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছি। ওখানে আমি অনেকগুলো নতুন মানুষকে পাবো, একে অপরকে আপন করে নেবো আমরা। কিন্তু ওখানে কেউ আমার বাবাই হয়ে উঠতে পারবে না। আমার একটাই বাবাই ছিল, আছে আর থাকবে। মন খারাপ হোক, কিংবা কোনো অকারণ আবদার... সবকিছু নিয়ে আমি তোমার কাছেই বারবার ছুটে আসবো বাবাই। সেই তোমার বুকেই ঝাঁপিয়ে পড়বো বারবার। আমি তো তোমারই একটা অংশ, তোমাকে ছাড়া আমার তো কোনো অস্তিত্ব নেই।

তনুময় বাবুর চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেছে। সেই ছোট্ট মেয়েটা কবে এত বড় হল কে জানে?
তনুময় বাবুর বুকে মিছরি ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। গাড়িটা বাড়ির গলি ছাড়িয়ে গেছে।
তনুময় বাবু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছেন যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়। মেয়েটা তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ঠিকই, তবু তনুময় বাবু জানেন ওনার মিছরি বারবার ফিরে আসবে ওনার কোলেই।
.
.
.
.
কলমে ~ সোহিনী অধিকারী

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)