প্রতিশোধ গল্পের লিংক
প্রতিশোধ .
পর্ব ০১
#রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। ডাঃ শামীমের চেম্বার। অন্যমনস্ক হয়ে নিজের চেয়ারে বসে আছে সে, সহকারী শফিক একটু ইতস্তত করে চেম্বারে ঢুকে আস্তে করে বলে — স্যার, আর কোনো রোগী নেই, রাত হয়েছে, বাড়ি যাবেন না? চমকে উঠে বললো — হ্যাঁ শফিক, এই যাচ্ছি, সব গুছিয়ে রেখে তুমিও চলে যাও।
ড্রয়ার খুলে ভিজিটের টাকাগুলো পকেটে ভরে উঠে দাঁড়াতেই ঘরের কোণে ঝুলানো কঙ্কালটার দিকে তার দৃষ্টি পড়লো… হ্নদয়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো শামীম, র্দীঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো সে। ডাক্তার হিসাবে তার খুব সুনাম, চেম্বারে সব সময় ভিড় লেগেই থাকে, তার ভিজিট পাঁচশো টাকা, তাও রোগীর কমতি নেই, এছাড়া নামকরা একটা হাসপাতালের প্রফেসর… প্রচুর উর্পাজন তার, এত টাকা দিয়ে কি করবে সে, একা মানুষ…. গরীব আত্মীয়স্বজন, এতিম, অসহায়… এদেরকে দান করে দেয়।
ফ্ল্যাটে ঢুকতেই মিষ্টি মধুর একটা কন্ঠস্বর বলে উঠলো —- বাকি রাতটুকু শেষ করে এলেই তো পারতে? আমি যে একা একা থাকি, এত রাত র্পযন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করি — সাহেবের খেয়ালই থাকে না।
হাসি মুখে শামীম বলে — রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি, এত রোগী থাকে, কাউকে ফেরাতে পারি না, আর কতদিন না বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নিয়ো, তা বেগম সাহেবের খেয়াল থাকে না?
ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো স্বরটা — হ্যাঁ, স্বামী বাইরে খেয়ে না খেয়ে পরিশ্রম করছেন আর আমি স্বার্থপরের মত আগেই খেয়ে নেবো তাই না?
— প্রিয় সখী, জেনে শুনেই এই অধমকে বরণ করেছো তুমি, এখন রাগ করলে চলবে কেন? নাও, টাকাগুলো ধরো….. বলে পকেটে হাত দিয়েই চমকে উঠলো… শামীম শূন্য ঘরে একা দাঁড়িয়ে আছে, আর কেউ নেই ঘরে।
অবসন্নের মত টলতে টলতে শোবার ঘরে এসে বিছানায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো, বিছানার পাশের ছোট টেবিলে মায়ার হাসি মুখের একটা ছবি রাখা, কি মিষ্টি হাসি…. তার দিকেই তাকিয়ে হাসছে মনে হয় —- আজ তিন বছর হলো তার ঘর শূণ্য…. প্রিয়তমা স্ত্রী মায়া নেই…. তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে ঐ নিশি গগনে – তারা হয়ে জ্বলছে।
………….
তিন বছর আগের ঘটনা —- একদিন, বেশ রাত হয়ে গেলো শামীমের বাসায় ফিরতে, কলিং বেল টিপলো, দরজা খুললো না, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবারও বেল টিপলো, না মায়া, না বুয়া… কেউ আসছে না, দরজার চাবি একটা তার কাছে থাকে, সেটা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে অবাক হলো সে, পুরো ফ্ল্যাট অন্ধকার, কোনো ঘরেই আলো জ্বলছে না…. বুকটা তার কেঁপে উঠলো, কি হয়েছে? তার মায়ার কিছু হয়নি তো! বসার ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে মায়াকে ডাকতে লাগলো, বুয়াই বা কোথায়, কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই।
প্রায় দৌড়ে শোবার ঘরে এলো শামীম, ঘর খালি, মায়া নেই, বিছানাটা এলোমেলো হয়ে আছে, অন্যান্য জিনিসপত্র সব তছনছ… যেন ঝড় বয়ে গেছে ঘরটাতে। আঁতকে উঠলো, হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো ওর। দৌড়ে বাথরুমে ঢুকেই আর্তনাদ করে উঠলো…. মায়া পড়ে আছে মেঝেতে, শরীরে একটা সুতোও নেই, মুখ বাঁধা, বিষ্ফারিত খোলা চোখে আতঙ্ক এবং কষ্টের ছাপ স্পষ্ট।
অভিজ্ঞ ডাক্তার, দেখেই বুঝলো মায়া আর নেই। উন্মাদের মত ছুটে যেয়ে সযত্নে কোলে তুলে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে চাদর দিয়ে শরীরটা ঢেকে দিলো তারপর পুলিশকে জানালো। পুলিশ এসে তন্ন তন্ন করে খুনীর আলামত খুঁজতে লাগলো কিন্তু কিছুই পাওয়া গেলো না।
বুয়া অজ্ঞান হয়ে রান্নাঘরেই পড়েছিলো, তারও হাত মুখ বাঁধা, মাথায় আঘাত করা হয়েছিলো। জ্ঞান ফিরলে ও কিছুই বলতে পারলো না, সে রান্না করছিলো হঠাৎ পিছন থেকে মাথায় বাড়ি দেয় কেউ। না কাউকে সে দেখতে পায়নি তবে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলতে বেরিয়ে এসেছিলো, বসার ঘরে ভাবী টিভি দেখছিলো, ভাবীই বললো… তুমি যাও, আমি দেখছি কে এলো, তারপর কি হয়েছে, সে বলতে পারবে না, কেবল একজন পুরুষের অস্পষ্ট স্বর শুনতে পেয়েছিলো এবং কতক্ষণ পরে আততায়ী আচমকা পিছন থেকে আক্রমণ করে।
পোষ্টর্মটেমে জানা গেলো, মায়াকে একাধিকবার র্ধষণ করে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়, খুব পরিকল্পিত এবং ঠান্ডা মাথায় কাজটা করেছে খুনী, অতিমাত্রায় সাবধানী ছিলো, হাতে দস্তানা পরেছিলো তাই কোথাও হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি… পাশবিক অত্যাচারের ধরন থেকে আন্দাজ করা যায় যে র্ধষক আক্রোশ মিটিয়েছে মেয়েটার সাথে। ফ্ল্যাটের র্গাড সে সময় বাথরুমে গিয়েছিলো সুতরাং সেও কিছু বলতে পারলো না, গেট অরক্ষিত রেখে যাওয়াটা তার ঘোর অন্যায় হয়েছে, চাকরি থেকে তাকে বরখাস্তও করা হয়েছে কিন্তু আর কি হবে, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
কোন পাষন্ড মায়াকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে মারলো? কেন? কাউকে সন্দেহ করে কিনা শামীম জানতে চাইলো পুলিশ কিন্তু সে বলতে পারলো না, ওদের দুজনেরই আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু বান্ধব তেমন ছিলো না সুতরাং কার নাম বলবে?
অনেক চেষ্টা করলো পুলিশ কিন্তু খুনী ধরা পড়লো না।
শামীম একটা কাজ করলো, কারো কথা শুনলো না, মায়াকে তখনই কবর দিতে দিলো না, সে নিজে ডাক্তার… অন্য দুজন ডাক্তারের সহযোগিতায় মায়ার কঙ্কালটা আস্ত বের করে নিজের চেম্বারে ঝুলিয়ে রাখলো… হোক কঙ্কাল — তবু তো সেটা মায়ার, ওর চোখের সামনেই থাকবে মায়া তার ভালোবাসা। এরপর শরীরের সব কিছু দাফন করে দিলো।
ওর এই কাজটাকে অন্য সবাই পাগলামী ছাড়া আর কিছুই ভাবলো না…. হ্যাঁ, সে পাগল, মায়া তার অস্তিত্বে মিশে ছিলো, অসময়ে তাকে হারিয়ে শোকে, নাওয়া খাওয়া ভুলে উন্মাদের মত হয়ে গেলো, কাজ র্কম কিচ্ছু করতো না, শামীমের দুর সম্পর্কের এক খালা সে সময় ওর কাছে থেকে আদর যত্ন করে সুস্থ করেন আর সহকর্মীদের সহানুভূতি তো ছিলোই। নিজেকে সুস্থির শান্ত করে অবশেষে কাজে ব্যস্ত থেকে মায়াকে ভুলতে চেষ্টা করেছে।
সে যেন এক যন্ত্র, বেঁচে থাকতে হবে তাই আছে, আত্মহত্যা মহাপাপ, আল্লাহ্ কখনো এই পাপ মাফ করবেন না তাই নিজেকে শেষ করতে পারেনি।
মায়াহীন শামীম যেন আত্মা ছাড়া শরীর।
এরপর শামীম আর কাউকেই সহ্য করতে পারে না, একা থাকতেই পছন্দ করে… খালা বুঝলেন ওর মানসিক অবস্থা, আবার বিয়ে করতে বললেন কিন্তু শামীম রাজী হলো না। বুয়াকে বিদায় করে একজন কম বয়সী ছেলেকে রাখলো… রাজু, যে তার সব কাজ করে, রান্নাও।
চেম্বার থেকে ফিরে শ্রান্ত দেহে কোনো মতে সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ে…. বিছানায় শুতেই সিনেমার মত তার চোখে ভেসে উঠতে থাকে অতীতের মধুর স্মৃতিগুলো।
গল্পটা লিখেছি বিদেশী সিনেমার ছায়া অবলম্বনে।
চলবে….
প্রতিশোধ র্পব ১ সমাপ্ত
# # প্রতিশোধ
র্পব ২
মায়াকে প্রথম দেখে শামীম তার চেম্বারে। চাচাকে নিয়ে এসেছিলো ডাক্তার দেখাতে। মায়ার মা বাবা মারা যান অনেক আগেই, চাচার কাছে মানুষ। চাচারও একটা করুণ অতীত আছে…. স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে চাঁদপুরে আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো, ফেরার পথে লঞ্চ ডুবিতে বহু যাত্রীর সাথে তারা মারা যায়। এই অসহনীয় যন্ত্রণা তিনি ভুলতে চেয়েছেন মায়াকে নিয়ে… এতিম মেয়েটিকে পিতৃস্নেহে লালন পালন করেন।
অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে শামীমের মাথা ঘুরে যায় এবং সুদর্শন শামীমও বুঝতে পেরেছিলো মায়াও তার প্রতি র্দুবল। অসুস্থ চাচাকে ডাক্তার দেখাবার সূত্র ধরেই দুজনে পরস্পরের খুব কাছে চলে আসে। চাচার কাছে শামীম তার সহকর্মীর মারফত মায়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়… শামীমের মত এত উপযুক্ত পাত্রকে অপছন্দ করার প্রশ্নই নেই… আদরের ভাইজির সুব্যবস্থা হওয়ায় তিনি অত্যন্ত খুশী মনেই সম্মতি দেন।
বেশ ধুমধাম করেই বিয়েটা হয়ে যায়, উভয় পক্ষের কম নিমন্ত্রিত অতিথি হয়নি…. সানন্দেই সবাই নব দম্পতিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দাওয়াত খেয়ে গেলো। শামীমের শূণ্য ঘর মিষ্টি বৌয়ের আগমনে পরিপূর্ণ হলো। উভয়ে মনের মত জীবন সাথী পেয়ে খুশীর জোয়ারে ভেসে গেলো।
চাচা আগেই অসুস্থ ছিলেন, শামীম আন্তরিক চেষ্টা করেও ওনাকে ধরে রাখতে পারলো না…. স্ট্রোক করে মারা গেলেন… দ্বিতীয় বার পিতৃহারা হয়ে মায়া খুবই কষ্ট পেলো কিন্তু স্বামীর প্রাণ ঢালা ভালোবাসা ও সপ্রেম সাহচর্যে মায়া শামীমকে অবলম্বন করে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পেয়ে সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইলো।
মায়া নিজেকে সামলে সংসারে মন দিলো, চাচাকে মনে পড়ে আর বুকের মধ্যে কষ্ট অনুভব করে, চাচা না থাকলে কোথায় ভেসে যেতো, শামীমের মত স্বামী পেয়েছিলো তাই সহজেই শোক ভুলতে পারছে।
যাইহোক, মায়াকে খুশী রাখার জন্য শামীম সিদ্ধান্ত নেয়… হানিমুনে যাবে। একটু দোনোমনো করে অবশেষে মায়া রাজী হয়ে গেলো।
হানিমুনে শামীম দেশের বাইরে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু মায়া রাজী হয়নি, প্লেনে চড়তে তার ভয় লাগে সুতরাং কাপ্তাই – রাঙামাটি – কক্সবাজার – হিমছড়ি ইত্যাদি প্রায় সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছে।
কি যে খুশী হয়েছে মায়া, ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত আনন্দে স্বামীর হাত ধরে সারাদিন ঘুরেছে… যা মন চায় খেয়েছে, প্রাণ ভরে শপিং করেছে। রাতে হোটেলের নিভৃত কক্ষে রোমান্টিক পরিবেশে স্বামীর উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দিয়ে আবেশ মাখা তৃপ্তির স্বরে বলেছে…. ওগো, এত সুখ আমার সইবে তো….
শামীম কোনো জবাব দিতে পারেনি শুধু মায়ার পেলব কোমল দেহকে আপন শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে।
না, মায়ার কপালে সত্যিই অত সুখ সহ্য হয়নি — কোন নিষ্ঠুর পাষাণ র্নিমম ভাবে শান্ত সুন্দর মিষ্টি মেয়েটির সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ করে দিলো… মাত্র বিকশিত পদ্মের মত পাঁপড়ি মেলছিলো।
…………
রাজুর ডাকে কঠিন বাস্তবে ফিরে এলো শামীম,
— সাহেব, খানা দেবো টেবিলে?
তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে বিষন্ন সুরে বললো শামীম… রাজু কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো, আমাকে শুধু এক গ্লাস দুধ দিয়ে যেও।
যেতে যেতে রাজু ফিরে তাকালো, সে সবই জানে, বড় কষ্ট হলো তার এই ভালো মানুষ মনিবের জন্য, মানুষ কি করে এত অন্যায় জঘন্য কাজ করতে পারে, সেটা স্বল্প জ্ঞানের রাজু বুঝতে পারেনা, শুনেছে খুনী ধরা পড়েনি…. নীচু স্বরে বললো রাজু…. শয়তানটাকে পেলে আমিই খুন করে ফেলবো।
শামীম উঠে বাথরুমে যেয়ে মুখে হাতে ভালো করে পানি দিয়ে এসে দুধ খেলো, সাথে একটা ঘুমের ওষুধ… খুব বেশী অস্থির লাগে যেদিন, সেদিন ওষুধটা খেতেই হয় তাকে, ঘুমের ওষুধের অপকারিতা ডাক্তার হিসাবে জানা সত্ত্বেও খায় সে, কি করবে…. মায়াবী মেয়েটাকে ভুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারে না যে।
ওষুধের প্রভাবে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হতে থাকে চেতনা, আধো ঘুম আধো জাগরণে শামীম অনুভব করে, তার মাথার কাছে মায়া এসে বসেছে, ওর শরীরের সুগন্ধও পায়, জড়িত স্বরে শামীম বলে…. মায়া ঘুম আসছে না —
সুরেলা কন্ঠে মায়া বলে —- আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুমি ঘুমাও গো।।
মাথায় প্রিয়তমার কোমল হাতের স্পর্শ টের পায়, সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে মায়াকে জড়িয়ে নেয়…. ঘুমিয়ে পড়ে শামীম।
শুক্রবার চেম্বার বন্ধ থাকে। বাড়িতে থাকতে শামীমের মোটেও ভালো লাগে না, কারো কাছে যেতেও মন চায় না, হাসপাতালেও আজকে যেতে হয় না, কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকলে তবু ভুলে থাকা যায়, এতদিন হয়ে গেলো তারপরও হতভাগিনীর স্মৃতি মন থেকে মুছে গেলো না…. বিশেষ করে অত্যাচারিত মায়ার মুখের কষ্টের ছাপ তাকে তাড়া করে ফেরে, স্বামী হয়েও স্ত্রীকে নিরাপত্তা দিতে সে অক্ষম হয়েছে, এই মানসিক যন্ত্রণা তাকে শান্তি দেয় না।
অনেকের বলা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বার বিয়ে করেনি, মায়ার জায়গায় কাউকেই সে কল্পনাও করতে পারে না।
মনে পড়ে… মায়া প্লেনে চড়তে ভয় পেতো, বলতো… মাগো, কত উঁচুতে ভেসে থাকে ঐ ভারী জিনিসটা, কোনো ভাবে পড়লে আর রক্ষা নেই, বেঁচে থাকা যাবে না…. অথচ নিজের বাড়িতে নিরাপদে থেকেও সে বাঁচতে পারলো না।
চলবে….
পর্ব ৩ ও শেষ পর্ব
#প্রতিশোধ ৩য় ও শেষ পর্ব
চিন্তাচ্ছন্ন শামীম কলিং বেলের আওয়াজে সচকিত হলো, অল্প পরেই রাজু এসে বললো… সাহেব, আপনার একজন বন্ধু আসছেন, দেখা করতে চায় আপনার সাথে।
এত বিরক্ত লাগলো শামীমের, কিছু করার নেই, বাড়িতে কেউ এলে তাকে চলে যেতে বলা যায় না। বসার ঘরে এসে দেখলো আসাদ বসে আছে, পুরনো বন্ধু, আগেও বাসায় এসেছে, মাঝখানে বহুদিন আর আসেনি।
শামীম জোর করে হাসি আনলো মুখে…. আরে তুমি! কি খবর, কেমন আছো? এতদিন কোথায় ছিলে?
রাজুকে চা নাস্তা আনতে বলে বসলো শামীম। আসাদও হাসিমুখেই জবাব দিলো…. আমি ভালোই আছি, এতদিন আমেরিকায় ছিলাম। তোমরা কেমন আছো? ভাবীকে দেখছি না, কোথায় সে? ডাকো, তার হাতের চায়ের স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনি।
— মায়া নেই। সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো শামীম।
— বাইরে গেছে বুঝি, শপিং?
— না, মায়া মারা গেছে।
আঁতকে উঠলো আসাদ — বলছো কি তুমি! কিভাবে?
শীতল স্বরে বললো শামীম — ওকে খুন করা হয়েছিলো…
চমকে উঠলো আসাদ —- খুন! কেন, কে করলো? খুনী ধরা পড়েছে?
গম্ভীর হয়ে গেলো শামীম…. এই প্রসঙ্গ থাক, অন্য কথা বলো, আমেরিকায় কবে গেলে, কিসের জন্য গিয়েছিলে…
আসাদ কথা বলতে লাগলো ঠিকই কিন্তু সেও যেন বির্মষ, অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। বসে বসে বেশ খানিকক্ষণ গল্প করলো দুই বন্ধু, চা টা খেলো তারপর আসাদ বললো — এত ভালো মেয়েটাকে খুন করলো কে, আশ্চর্য! কাউকে সন্দেহ হয়নি?
শামীম অনিচ্ছার সাথে বললো —- না, কাকে সন্দেহ করবো? কোনো সূত্রই পাওয়া যায়নি, তাছাড়া প্রমাণ ছাড়া…
বলতে বলতে থেমে গেলো শামীম, আসাদ কিন্ত থামলো না, রসিকতার সুরে বলে উঠলো…. এই দেখো, তুমি আবার আমাকেই খুনী ভাবছো না তো?…. এটা যেন সেই প্রচলিত কথা ‘ ঠাকুর ঘরে কে রে…. না আমি তো কলা খাইনি ‘ — বিরক্ত হয়ে শামীম বললো…. কি যা তা বলছো, তোমাকে কেন খুনী ভাববো, কি মুস্কিল….
এরপর ওদের কথা আর জমলো না, কিছুক্ষণ পরে আসাদ চলে গেলো।
সে চলে যাওয়ার পরেই শামীমের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো…. মায়া একদিন বলেছিলো যে আসাদ প্রায়ই নাকি বাসায় আসে, সে সময়টা শামীম বাসায় থাকে না, মায়ার একটুও ভালো লাগে না। অতি ভদ্র, শান্ত মেয়ে মায়া… মানাও করতে পারে না, স্বামীকে বলেছিলো — তুমি ওকে আসতে মানা করে দিয়ো, ওর চোখের দৃষ্টি, কথাবার্তা ভালো না।
শামীম তখনই ফোন করে আসাদকে মানা করে দেয়…. মায়া পছন্দ করে না, তুমি আর এসো না।
এরপর আসাদ আর আসেনি। মায়ার ওপর আসাদের নজর ছিলো, ওই এই ঘৃণিত কাজ করেনি তো? কিন্তু আমেরিকা যাওয়ার যে সময়ের কথা আসাদ বললো, সেটা মায়া খুন হওয়ার আগে, সে সময় তো আসাদ দেশেই ছিলো না।
কয়েক দিন পর… শামীম চেম্বারে রোগী দেখছিলো
শফিক এসে জানালো স্যারের বন্ধু আসাদ এসেছেন, শামীম খুব অবাক হলো তারপর বললো… ঠিক আছে, একটু বসতে বলো, আমি এই কাজটা শেষ করেনি, বেশীক্ষণ লাগবে না।
আসাদ চেয়ারে বসতে শামীম বললো… কি ব্যাপার তুমি হঠাৎ!
অবসন্নভাবে আসাদ উত্তর দিলো… শরীরটা কদিন থেকে খারাপ লাগছে, তুমি থাকতে আর কাছে যাবো।
শামীম কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করলো, প্রেশার দেখলো তারপর প্রেসক্রিশন লিখতে লিখতে বললো…. কয়েকটা পরীক্ষা করতে দিলাম, করিয়ে নাও, আন্দাজে তো ওষুধ দেওয়া যায় না, পরীক্ষার পর রিপোর্ট দেখে….
এই সময় একটা ঝমঝম আওয়াজ হতে মুখ তুলে শামীম স্তম্ভিত হয়ে গেলো, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না এই অলৌকিক, অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে…. মায়ার কঙ্কালটা হেঁটে আসছে…. আসছে… এসে ঠিক আসাদের পেছনে দাঁড়ালো… গোটা শরীরটা কঙ্কালের কিন্তু মুখটা রক্ত মাংসের মায়ার…. লাবণ্যবতী রূপসী মায়া নয়…. হিংস্র, মোমের মত সাদা মুখ, চোখ থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।
এদিকে শামীমকে বিস্মিত চোখে তার পেছনে তাকাতে দেখে আসাদ ঘুরে দেখতে গেলো তারপরই আতঙ্কে বীভৎস চিৎকার করে উঠলো।
মায়া দুহাতে আসাদের গলাটা চেপে ধরলো…. শামীম শুধু চিৎকার করে বলতে পারলো ‘ মায়া… না ‘ তারপরই যেন পাথরে পরিণত হলো… বুঝতে পেরেছে সে, অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিলো — পরিচিত কেউ না হলে মায়া সেদিন দরজা খুলতো না, শামীমের নিষেধ ছিলো… কী – হোলে দেখে নিশ্চিত হয়েছে এবং আসাদ তার ইচ্ছা মত আক্রোশ মিটিয়েছে, খুনটাও করেছে পরিকল্পনা করে, কারণ মায়াকে বাঁচিয়ে রাখলে পুলিশ তো বটেই… শামীমও তাকে ছাড়তো না — প্রিয়তমা স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করার জন্য খুন করে ফেলতো আসাদকে।
মুখোশধারী শয়তানটার গলাটা চেপে ধরে অর্পাথিব ভয়াবহ স্বরে বললো মায়া…. ইবলিশ, জানোয়ার, কত মিনতি করেছি, হাতে পায়ে ধরেছি কিন্তু ছাড়িসনি তুই, এতদিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, আমাকে খুন করে তুই বাঁচতে পারবি? আমার সোনার সংসার তোর লালসায় ছারখার করে দিয়েছিস, দিনের পর দিন আমার স্বামী জ্বলে পুড়ে শেষ হয়েছে…. শেষের দিকে মায়ার স্বর করুণ হয়ে এলো।
এদিকে আসাদের অবস্থা কাহিল, দম বন্ধ হয়ে আসছে, চোখ দুটো ভয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। কঙ্কালের হাত দুটো ছাড়াবার বৃথা চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে চিৎকার শুনে শফিক ছুটে এসে এই ভয়াবহ অবিশ্বাস্য ব্যাপার দেখে জায়গাতেই জমে গেলো।
যত কষ্ট, বেদনা মায়া পেয়েছিলো আসাদকে ধরে রেখে উশুল করতে লাগলো… অবশেষে বললো…
— আমার স্বামীর কাছে স্বীকার কর সব কিছু নইলে মেরে ফেলবো তোকে।
রুদ্ধস্বরে বললো আসাদ…. বলবো, সব বলবো, আমাকে ছেড়ে দাও মায়া….
কাঁপতে কাঁপতে স্বীকারোক্তি দিলো আসাদ, শামীম ও শফিক শুনলো…. আসাদের কথা শেষ হওয়া মাত্র মায়ার বজ্র কঠিন চাপ আলগা হয়ে গেলো, মৃদু স্বরে বললো মায়া… এতদিন পরে শান্তি পেলাম আমি, মুক্তি হলো আমার আত্মার…. বলেই শামীমের দিকে তাকালো — সেই অপরূপ লাবণ্যবতী মায়া, দুচোখে তার অশ্রু টলমল করছে… একটু হাসলো, বেদনার হাসি তারপরই মিলিয়ে গেলো মায়ার মুখ এবং হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেলো কঙ্কালটা, ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো… কোনো ভাবেই আর জোড়া লাগানো যাবে না। শামীম ধীরে বললো…. শফিক পুলিশকে ফোন করো।
……… আসাদের কথা —
পুলিশ অফিসারদের সামনে বয়ান দিলো অপরাধী, মায়ার খুনী….. হ্যাঁ, আমি শামীমের স্ত্রী মায়াকে র্ধষণ করে গলা টিপে খুন করেছি। মায়ার ওপর আমি অনেক দিন থেকেই আসক্ত কিন্তু জানি আমার আশা কোনো দিনই পূরণ হবে না কারণ অনেক চেষ্টা করেও সতীলক্ষ্মী মায়াকে আমি ভোগ করার সুযোগ পেলাম না, অগত্যা ঠিক করলাম জোরপূর্বক আমার কামনা চরিতার্থ করবো। এরমধ্যে শামীম আমাকে ওদের বাসায় যেতে নিষেধ করায় অপমানে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো…. শামীম কোন সময় বাসায় থাকে না, সেটাতো জানতামই।
সেদিন ওদের ফ্ল্যাটের র্গাডকে ঘুস দিয়ে তার মুখ বন্ধ করেছিলাম… মায়া দরজা খুলতে চায়নি কিন্তু কাতর ভাবে বললাম — খুব পিপাসা পেয়েছে, পানি খেয়েই চলে যাবো, পানির কথা শুনে ও নরম হোলো, দরজা খুলে আমাকে বসতে দিয়ে পানি আনার জন্য ঘুরতেই ওর হাতটা ধরে মিনতি করে বললাম…. মায়া, আমি শামীমের চাইতে কম কিসে? আমার কাছে চলে এসো, রাজরাণী করে রাখবো তোমাকে….
মায়া ঝটকা দিয়ে হাত টেনে নিয়ে বললো… আপনি এই মূহুর্তে চলে যান নইলে বুয়াকে ডাকবো আর শামীমকেও ফোন করে এখনি আসতে বলবো তারপর যা করার ও করবে… শুনেই আমি দেরী না করে মায়াকে জাপটে ধরে প্রথমে ওর মুখে হাত চেপে ধরলাম…. ও হ্যাঁ, ঘরে ঢোকার আগেই আমি দস্তানা পরে নিয়েছিলাম, এরপর র্সবশক্তি দিয়ে ওকে টেনে শোবার ঘরে নিয়ে মুখ হাত পা বেঁধে বিছানায় ফেলে রেখে রান্নাঘরে গেলাম বুয়ার ব্যবস্থা করতে…. মায়া বাঁধা অবস্থায়ও চেষ্টা করেছে নিজেকে রক্ষা করতে কিন্তু আমার সাথে পারবে কেমন করে…. তারপর —
অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে আসাদ আবার বলতে লাগলো…. আমি কখনোই আমেরিকায় যাইনি কেবল বহুদিন আত্মগোপন করে ছিলাম। সেদিন শামীমের বাসায় গিয়েছিলাম পরিস্থিতি জানতে, দেখি বাঃ কেউ কিছু ধরতেই পারেনি, আর আহাম্মকটা তো কাউকে সন্দেহই করে নাই, যাক মুখে হায় আফসোস করলাম এবং শামীমের করুণ দশা দেখে অন্তরে উল্লাস বোধ করলাম — কিন্তু তখন জানতাম না যে র্ধমের কল বাতাসে নড়ে….
আর কিছু বলতে চাইলো না সে।
শামীম পুলিশকে কিছু গোপন করেনি, কঙ্কালের কথা সবই ভেঙে বলেছিলো, নইলে আসাদ এত সহজে খুনের কথা স্বীকার করলো কেমন করে — তার কি জবাব দিতো… শফিকও সাক্ষী দিলো তাছাড়া আসাদের গলায় কঙ্কালের হাতের হাড়ের দাগ স্পষ্টই দেখা গেছে।
র্বতমান যুগের মানুষ বিশেষ করে পুলিশ অলৌকিক বা অশরীরি ব্যাপার বিশ্বাস করবে না, নিরেট প্রমাণের ভিত্তিতেই তারা তদন্ত করে… কিন্তু পৃথিবীতে ব্যাখ্যাহীন অবিশ্বাস্য অনেক রহস্য আছে যার সমাধান হয়নি… মায়ার ঘটনাও এমনই একটি রহস্য।
যাই হোক, পুলিশের বিশেষ বিবেচনায় এবং সহযোগিতায় কঙ্কালের ব্যাপার গোপন রেখে মায়া হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়… খুনী নিজেই যখন তার অপরাধ স্বীকার করেছে তখন আর প্রমাণের দরকার ছিলো না।
বিচারে আসাদের ফাসীর আদেশ হয় এবং খুনীকে সাহায্য করার অপরাধে র্গাডের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
শামীম মায়ার প্রতি অন্যায়ের ন্যায় বিচার হওয়ায় অনেক শান্তি পায়, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন শুরু করে…. বেশ কিছু দিন পরে সে পুনরায় বিয়েও করে, সুন্দরী, বুদ্ধিমতি পিয়া স্বামীর ছায়া হয়ে, অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে তার সব বেদনা ভুলিয়ে দেয়।
শামীম দুই সন্তানের পিতা এবং প্রিয়তমা স্ত্রীর আর্দশ স্বামী…. অত্যন্ত সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করছে।।
সমাপ্ত ****