বাবার রাজকন্যা

@Admin
0




 "বাবা ! তুমি প্রতিদিন এভাবে সকাল বেলা লাড্ডু নিয়ে এই বাসায় চলে আসো কেনো ? তুমি কি বাচ্চা ! তুমি কেনো বুঝোনা যে আমি এখন আরেকজনের সংসার করি ! তোমার প্রতিদিন এই বাসায় আসাটা এই বাড়ির অনেকেই ভালো দৃষ্টিতে নেন না !

আমার শ্বাশুড়ি গতকালও বলেছেন -
' বেয়াই মানুষ যদি প্রতিদিনই আসে তবে বেয়াই এর দাম থাকে ? '
আমি আর লাড্ডু খাইনা বাবা ! লাড্ডু নিয়েও সবাই হাসাহাসি করে l আমার ছোট ননদ গতকাল সবার সামনে হাসতে হাসতে বলেছে - ' লাড্ডুওয়ালা আজকেও এসেছে ? '
তুমি কেনো বুঝতে চাওনা বাবা ? আমি ভালো আছি! ( দীর্ঘশ্বাস ..........! ) অনেক ভালো l তুমি ওষুধ খেয়ো নিয়মিত বাবা , মায়ের দিকে খেয়াল রেখো।"
আমজাদ সাহেব আর তাঁর একমাত্র মেয়ে আফসানা দুজনের চোখেই পানি ....... ! তিনি একদৃষ্টিতে মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন,
- মেয়ের চোখে কষ্টের শৈবাল ভাসছে ! এই বিশ্বব্রক্ষান্ডের জঘণ্যতম পিতাও হয়তো মেয়ের চোখে ভাসমান কষ্টের শৈবাল দেখতে পারেন l
কি কষ্ট! কি কষ্ট!
আমজাদ সাহেবের সামনের ছোট্ট টেবিলে এককাপ চা, একগ্লাস পানি আর তাঁর কিনে আনা এক প্যাকেট লাড্ডু !
তাঁর খুব ইচ্ছে করছে পরনের পাঞ্জাবী দিয়ে আফসানার চোখের পানি মুছে দিতে ! পারছেন না !
তাঁর মেয়ে আজ নিজের অনিচ্ছাতে , নিরুপায় হয়েই পিতা কণ্যার মধ্যে দূরত্বের একটা দেয়াল তুলে দিলো l
আমজাদ সাহেব কিছু না বলেই গেইটে এগিয়ে গেলেন, হঠাৎ আফসানা বাবার পাঞ্জাবী টেনে ধরলো , মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদছে, চুপচাপ ......!
কান্নায় কোনো শব্দই নেই ! অথচ দেড়মাস আগেও তাঁর বাসায় আফসানা ছোট্ট বিষয়েই চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিতো, ঠোঁট ফুলিয়ে কত্তো আহ্লাদ করতো ! আহা মেয়ে !
বিয়ের মাত্র দেড়মাসের মাথাতেই একটা নারীর কি পরিবর্তন !

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আফসানা জিঞ্জেস করলো - ' বাবা ! তুমি কি নাস্তা করেছো ? '
- ' হ্যাঁ মা ! করেছি , শরীরে ইনসুলিন নিয়ে নাস্তা না করলে তোর এই বুড়ো বাপ হাঁটতে পারতো , এতোক্ষণ কথা বলতে পারতো ? '
আফসানা বাবার বুকে মাথা রেখে এবার হা করে শব্দবিহীন কান্না কাঁদছে l আমজাদ সাহেব অনুভব করছেন,
- পাঞ্জাবীর সামনের অংশ অাফসানার চোখের পানিতে ভিজে গেছে l

আমজাদ সাহেব বেরিয়ে পড়লেন, রাস্তা দিয়ে একাএকা হাঁটছেন , সকালে ভদ্রলোক নাস্তা করেননি, শরীর ঘামছে, দূর্বল লাগছে তাঁর l রক্তে গ্লুকোজ কমে যাচ্ছে , সকালে ইনসুলিন নিয়ে কিছু খাওয়া উচিত ছিলো l
ফোন বাজছে, কাঁপা কাঁপা হাতে স্ক্রীণে তাকিয়ে দেখলেন মেয়ের ফোন!
- ' হ্যাঁ মা ! বল !
-' বাবা ! বাবা ........................ বাবা ..........! তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা, ওরা তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, কটু কথা বলে! আমার সহ্য হয়না ! তুমি এতো ঘনঘন এই বাসায় আর আসবানা ! ( হাউমাউ কান্নার শব্দ............ ) '
কোন কথা নেই আর ..... শুধুই কান্না !
একটু পর আমজাদ সাহেব শুনলেন,
' তোমরা বাপবেটি কয়েকদিন পরপর এমন কান্নাকাটি করো কেন্ বৌমা ? বলি, সংসার কি আর কোনো মেয়ে করে না ? তুমি একটা ........ ' পিপ ...... পিপ ......পিপ ( ফোন কেটে দেয়ার শব্দ )

আমজাদ সাহেব একটা টং দোকানে বসলেন , আস্তে করে বললেন - ' আমাকে কড়া চিনি দিয়ে এককাপ চা দিন বাবা ! তাড়াতাড়ি ! '
দোকানদার ভ্রুঁ কুঁচকে জিঞ্জেস করলো -
' আবার কন্ তো চাচা মিয়া চিনি বাড়াইয়া দিমু নাকি লিকার বাড়াইয়া চিনি ছাড়া চা দিমু l আপ্নের কি ডায়াবেটিস নাই ? '
আমজাদ সাহেব উপরে আকাশের দিকে তাকালেন , আকাশে মেঘ জমেছে ! রিটায়ার্ড জীবনে সঙ্গীহীন এই মানুষটা l স্ত্রী ( আফসানার মা ) স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী আজ তিন বছর , নড়াচড়া করতে পারেন না তেমন, কথাবার্তা বলতে পারেন না , শুধু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকেন l

আকাশে অনেকগুলা কাক উড়ছে, আমজাদ সাহেবের শরীর ঘামছে , মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী আজ চরকীর মতো ঘুরছে l

রক্তে সুগার একেবারেই কমে যাচ্ছে তাঁর, দোকানদার হা করে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে , উত্তরের অপেক্ষায় l কিন্তু আমজাদ সাহেব উত্তর দিতে পারছেন না, ঠোঁট কাঁপছে তাঁর l
আমজাদ সাহেবের মস্তিষ্ক দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ছে , ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ফিরে গেছে বাইশ বছর আগের এক স্মৃতিতে !
আফসানার বয়স এখন তিন বছর l
অফিস ফেরত আমজাদ সাহেব কলিংবেল চেপেছেন, ছোট্ট আফসানা দৌড়ে এসে জিঞ্জেস করলো,

- ' আমাল ( আমার) লাড্ডু আনছো বাবা ! '

আমজাদ সাহেব হাসতে হাসতে বলছেন -

' হ্যাঁ মা ! বাবা মৃত্যুর দিনও তোর পছন্দের লাড্ডু নিয়ে হাজির হবো! বাবা সব ভুলে যাবো, কিন্তু তোর লাড্ডুর কথা কোনোদিনই ভুলবো নারে মা ll '

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)