শৈশব

@Admin
0




 



স্যার, রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া ঝালমুড়ি খেতে কেমন?"

ক্লাস ফাইভে পড়ে আমার ছাত্র রাফির মুখে এমন কথা শুনে আমি একটু অবাক হলাম। আমি তখন রাফিকে বললাম,
-- কেন, তুমি কি কখনো ঝালমুড়ি খাও নি?
রাফি বললো,
-" বাসায় বানানো ঝালমুড়ি খেয়েছি কিন্তু বাহিরের বিক্রি হওয়া ঝালমুড়ি কখনো খাই নি। আম্মু আমাকে খেতে দেয় না। আম্মু বলেছে যারা বাহিরে ঝালমুড়ি বিক্রি করে তাদের হাত নাকি অপরিষ্কার থাকে। ওদের থেকে ঝালমুড়ি খেলে পেটে অসুখ হবে"
আমি বললাম,
-- তোমার স্কুলের কোন বন্ধুরাও কি বাহিরের ঝালমুড়ি খায় না?

রাফি কিছুটা মনমরা হয়ে উত্তর দিলো,
-" আমি বাদে সবাই খায়। ওরা বলেছে ওদের পেটে অসুখ হয় না আর খেতেও নাকি খুব মজা"

কথাটা বলে রাফি ওর লেখার কাজে মনযোগী হয়ে গেলো। আমি রাফির দিকে তাকিয়ে অনেক কিছুই ভাবতে লাগলাম...

পরের দিন রাফিকে যখন পড়াতে যাই তখন আমি রাফির জন্য ১০টাকার ঝালমুড়ি কিনে নিয়ে যাই। রাফির হাতে ঝালমুড়ির প্যাকেটটা দিয়ে বললাম,
-- এটা বাহির থেকে বানানো ঝালমুড়ি । খেয়ে দেখো কেমন লাগে

রাফি ঝালমুড়ি খেতে লাগলো। ওর চোখে মুখে এক ধরনের তৃপ্তির হাসি। ঝাল হয়তো ওর একটু বেশিই লেগেছে। খেয়াল করে দেখি রাফির চোখ দিয়ে পানি পরছে আর সারা মুখ লাল হয়ে গেছে। এমন সময় রাফির মা নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকলো। রাফির অবস্থা দেখে অবাক হয়ে বললো,
-"রাফি তোমার কি হয়েছে? তোমার চোখমুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? আর এইসব কি খাচ্ছো?"

রাফি উত্তর দেওয়ার আগে আমি আন্টিকে হেসে বললাম,
-- তেমন কিছু না আন্টি। রাফি কখনো বাহিরের ঝালমুড়ি খায় নি তাই ওর জন্য বাহির থেকে ঝালমুড়ি নিয়ে এসেছিলাম। এখন দেখি ঝালমুড়ি খেয়ে ঝালে বেচারার অবস্থা খারাপ

কথাটা বলে আমি আমার মতো করে হাসতে লাগলাম। আমার হাসি দেখে রাফিও হেসে দিলো। আমাদের হাসি হয়তো আন্টি সহ্য করতে পারে নি। উনি সাথে সাথে রুম থেকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আন্টি আমায় ডেকে অন্য রুমে নিয়ে গেলেন। অন্য রুমে ঢুকে দেখি রাফির বাবা বসে আছে। আমি উনাকে দেখে সালাম দিলাম কিন্তু উনি আমার সালামের উত্তর না দিয়ে মুখটা গোমড়া করে বললো,
-"তুমি কাজটা ঠিক করো নি। আমার সন্তানকে বাহিরের এমন ফালতু খাবার খাওয়ানো তোমার উচিত হয় নি। তোমার এতই যেহেতু তোমার ছাত্রকে খাওয়ানোর শখ তাহলে ভালো কিছু খাওয়াতে এমন অস্বাস্থ্যকর খাবার কেন খাওয়াতে গেলে?"

পাশে বসা আন্টি তখন বললো,
-" তুমি আমার ছেলেকে দুইটাকা দামের চকলেট কিনে দিলেও আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু তুমি কি না ধুলোবালিতে বানানো ঝালমুড়ি খাওয়ালে আমার ছেলেকে"

আমি মাথা নিচু করে তখন বললাম,
--আসলে রাফির ইচ্ছে ছিলো বাহিরের ঝালমুড়ি খেতে কেমন সেটা জানার। তাই আমি ওর ইচ্ছেটা পূরণ করলাম শুধু

আমার কথা শুনে রাফির বাবা কিছুটা রেগে গিয়েই বললো,
-" আমার ছেলের ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়েছি নাকি? এখন আমার ছেলের যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে সেই ক্ষতি পূরণ কি তুমি দিবে?"

এমন সময় রাফি রুমে ঢুকলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-- তা ঝালমুড়ি খেতে কেমন লাগলো?
-"ভালো তবে আম্মুর হাতে বানানো ঝালমুড়ি খেতে আরো বেশি ভালো"
আমি মুচকি হেসে বললাম,
-- তুমি পড়ার রুমে যাও আমি ৫মিনিট পর আসছি

রাফি চলে গেলে আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-- আপনি যতই ভালো করে ঝালমুড়ি বানিয়ে আপনার সন্তানকে খাওয়ান না কেন সে কিন্তু সেই ঝালমুড়ি খেয়ে তৃপ্তি পেতো না। ওর মন পরে থাকতো রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া ঝালমুড়ির উপর। আজ যখন সে বাহিরের ঝালমুড়ি খেলো তখন সে নিজেই বুঝতে পারলো কোন ঝালমুড়িটা বেশি ভালো। এখন কিন্তু সে বাহিরের ঝালমুড়ি খেতে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করবে না কারণ সে এখন জানে বাহিরের বানানোর ঝালমুড়ির স্বাদ কেমন হয়। মাঝে মধ্যে অভিভাবকদেরও উচিত ভালো মন্দ বের করার তফাৎ সন্তানের উপর ছেড়ে দেওয়া

আর আংকেলের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললাম,
- আপনিও তো ছোটবেলা পার করেছেন। নিশ্চয়ই স্কুলের সামনে থেকে প্রচুর ঝালমুড়ি কিনে খেয়েছেন? আপনার কি কোন সমস্যা হয়েছে? তেমনি আমিও স্কুল কলেজে থাকা কালিন প্রচুর ঝালমুড়ি খেয়েছি এমনকি মাঝেমধ্যে এখনো খাই কিন্তু আমার আজ পর্যন্ত কিছু হয় নি। আপনি যে শৈশবটা পার করেছেন সেই শৈশবটা আপনার সন্তাকে ফিরিয়ে দেন। শুধু শুধু সন্তানকে কড়া শাসন আর বিধি-নিষেধের মাঝে আটকে রাখবেন না

আমার কথা শুনে আংকেল আন্টি চুপ হয়ে রইলো। আমিও আর কিছু না বলে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে গিয়ে রাফিকে পড়ানোর কাজে মনোযোগী হলাম....
---
-------

বন্ধুরা মিলে একবার মেলায় গিয়েছিলাম। আমি মেলার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মাটির খেলনা গুলো দেখছিলাম। এমন সময় খেয়াল করি কালো রঙের একটা প্রাইভেট কার থেকে ৫-৬ বছরের একটা ছেলে নেমেছে সাথে ওর বাবা-মা। আমার হাতে থাকা মাটির ষাড় গরুটাকে দেখে ছেলেটা ওর মাকে বললো,
-"আম্মু, আমায় এই ষাড়গরুটা কিনে দিবে?"

মহিলা মাটির খেলনা দেখে বললো,
-" এইসব ভালো না, পচা জিনিস"
ছেলেটা তখন ফোনে কথা বলতে থাকা ওর বাবাকে বললো,
-" আব্বু আমাকে এই ষাড়গরুটা কিনে দাও "

ভদ্রলোক তখন ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বললো,
-"না না বাবা, এইগুলো ভালো না। হাত থেকে পরে গেলেই ভেঙে যাবে। তোমাকে এর চেয়েও অনেক ভালো জিনিস কিনে দিবো"

ছেলেটা বারবার ওর বাবা মায়ের কাছে বায়না করছিলো মাটির গরুটা কিনে দিতে কিন্তু বাবা মা দুইজনেই ছেলেটাকে বুঝাচ্ছিলো এটা ভালো না এর চেয়েও ভালো জিনিস তাকে কিনে দিবে।
আমি তখন ছেলেটার মাকে বললাম,
-- আপা, বাচ্চাটা যেহেতু এতো করে বলছে কিনে দেন একটা। বেশি না ২০-৩০টাকার মত দাম হবে
মহিলাটা তখন বললো,
-"না না, শুধু শুধু এইসব কিনার কোন দরকার নেই"

ঘন্টাখানিক পর আমি বাসায় যাওয়ার জন্য যখন রিকশা খুঁজছিলাম তখন দেখি ছোট ছেলেটা মেলার গেইট দিয়ে বের হচ্ছে। ওর দুইহাত ভর্তি দামী সব খেলনা।কিন্তু তবুও ছেলেটার মুখটা মলিন।
আমি খেয়াল করলাম গাড়িতে উঠার পরও ছেলেটা গ্লাস খোলা জানালা দিয়ে একমনে মাটির খেলনা গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলো

আমার খুব খারাপ লাগছিলো এটা ভেবে আমরা অভিভাবকরা হাজার হাজার টাকা খরচ করে সন্তানকে দামী খেলনা কিনে দিতে পারি অথচ ২০-৩০ টাকা খরচ করে সন্তানের খুশি কিনে দিতে পারি না....
---
-----

ঈদের মৌসুমে কাপড়ের দোকানে খুব ভিড় থাকে। তাই বাবাকে সাহায্য করার জন্য আমি ঈদের সময়টাতে দোকানে বসতাম। একবার এক বাবা তার ১৪-১৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে আমাদের দোকানে এসেছিলো টি-শার্ট কিনতে। আমি ছেলেটাকে বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট দেখাচ্ছিলাম কিন্তু ছেলেটা পছন্দ করার আগেই ওর বাবা টি-শার্ট দেখে বলতো," এই রকম না অন্য ডিজাইনের দেখান"

ছেলেটা শেষে হলুদ রঙের একটা টি-শার্ট পছন্দ করেছিলো আর টি-শার্টের উপর লেখা ছিলো, কুল ম্যান। কিন্তু ছেলেটার বাবা টি-শার্ট দেখেই ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বললো,
"এইসব টি-শার্ট ফালতু ছেলেরা পরে। ভালো পরিবারের সন্তানরা এইসব উল্টো পাল্টা জিনিস লেখা টি-শার্ট কখনোই পরে না।"

ছেলেটার বাবা তখন উনার পছন্দের দুইটা টি-শার্ট কিনলো। আমি যখন হলুদ টি-শার্টটা গুছিয়ে রেখে দিচ্ছিলাম তখন ছেলেটা টি-শার্টটার দিকে মন মরা হয়ে তাকিয়ে ছিলো। আমার খুব খারাপ লাগছিলো এমনটা দেখে। আমি ভদ্রলোককে বললাম,
-- আংকেল আপনি মেরুন রঙের টি-শার্টটা না নিয়ে হলুদ টি-শার্টটা নেন। যেহেতু বাচ্চাটার পছন্দ হয়ছে। আপনি আমার কিনা দামের থেকে দরকার পরলে ৫০টাকা কম দিয়েন। তাছাড়া আপনার ছেলে তো ফর্সা। ফর্সা মানুষের সাথে হলুদ রঙটা মানাবে ভালো

ভদ্রলোক আমার দিকে বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে বললো,
-" তোমাদের দোকানদারের কাজেই হলো উল্টো পাল্টা বুঝিয়ে জিনিস বিক্রি করা। ফর্সা মানুষের সাথে শুধু হলুদ রঙ মানাবে মেরুন রঙ মানাবে না?"

আমি হেসে বললাম,
-- আসলে আংকেল, আপনার পছন্দ আর আপনার ছেলের পছন্দ তো এক হবে না। যেহেতু আপনার ছেলে এই টি-শার্টটা পছন্দ করেছিলো সেহেতু এটা নিতে বললাম আর কি

ভদ্রলোক কিছুটা রাগ করেই বললো,
-"আমার ছেলের পছন্দ অপছন্দ আমি দেখবো। তোমার সেটা নিয়ে না ভাবলেও চলবে"

আমি আর কথা না বাড়িয়ে টাকা নিয়ে ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলাম

আশির দশকের রুচিবোধের সাথে বর্তমান যুগের ছেলে-মেয়েদের রুচিবোধ মিলবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিভাবকরা সেটা মানতে নারাজ। আমরা অভিভাবকরা চাইলেই পারি নিজেদের ইচ্ছে সন্তানের উপর না চাপিয়ে দিয়ে সন্তানের পছন্দ অপছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে ওদের সুন্দর একটা শৈশব দিতে

রাফির বাবা মা ইচ্ছে করলে পারতো রাফিকে নিয়ে কোন এক বিকালে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খেতে। আজকাল ঝালমুড়ি খুব যত্ন সহকারে বানায়

ইচ্ছে করলে পারতো বাচ্চাটার বাবা-মা ৩০টাকা দিয়ে একটা মাটির ষাড় গরু কিনে দিয়ে বাচ্চাটার খুশিটা ফিরিয়ে দিতে

চাইলেই ভদ্রলোক হেসে তার সন্তানকে বলতে পারতো,
"তোর যেহেতু পছন্দ হয়েছে নে এই টি-শার্ট। কিন্তু এই টি-শার্ট পরে মাথা গরম করা চলবে না "

ইচ্ছে থাকলেই অভিভাবকরা পারে তাদের হারিয়ে ফেলা সোনালী শৈশবটাকে তাদের সন্তানের মাঝে খুঁজে পেতে

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)