অনুপস্থিতির অনুভূতি

@Admin
0



 ১.

বাড়ীতে পা রাখার সাথেই গায়ে আগুন ধরে গেল যেন। উফ্ এত্ত গরম!
মা কিভাবে থাক তোমরা? এত গরমে মানুষ থাকে? রিনি,রাইয়ান এ দিকে আসো ড্রেস চেন্জ করে দেই যা গরম না এখানে।

মা দৌড়ে গিয়ে হাত পাখা নিয়ে এল। আমি কটমট চোখে তাকিয়ে বললাম, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে তাও বসা যাচ্ছেনা আর তুমি এসেছ হাত পাখা নিয়ে,উদ্ধার করেছ মা।

মা ব্যস্ত হয়ে বলল, শরবত দেই? ঠান্ডা শরবত লেবু দিয়ে বানিয়ে ফ্রিজে রেখেছি, এক ঢোক খেয়ে দেখ শরীরটা ঠান্ডা হয়ে যাবে..... নানুদেরকেও দেই। বলে মা ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায়।

আমি মাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, উফ্ মা, আহ্লাদ করতে গিয়ে বিপদ ডেক না তো। ফ্রিজের খাবার খাওয়াব আমি ওদেরকে? পরে গিয়ে ঠান্ডা লেগে গেলে ওদের বাবা বলবে, দুদিন গিয়ে পারনি আর বাচ্চা দুটোর অসুখ বাঁধিয়ে এসেছ।

মা অসহায় মুখ করে তাকিয়ে থাকে। অবুঝ ছাত্রীর মা মা আমার একটুতেই কি করতে কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা ঠিক।

দীর্ঘ দেড় বছর পর বাড়ীতে এলাম এবার। বারো ঘন্টার ট্রেইন যার্নি করে দুই বাচ্চা নিয়ে এতদূর আসাটা চাট্টিখানি কথানা। আমার মা সোহেলী আক্তারের মত সহজ সরল অবুঝ মানুষ দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই। দিনের মধ্যে যতবার ফোন করবে তার একটিই কথা কতদিন হল তোদেরকে দেখিনা, কবে আসবি তোরা। সে ব্যস্ততা বুঝেনা,প্রয়োজন বুঝেনা, সময় অসময় বুঝেনা। ছোট মানুষের মত আব্দার করে বসে থাকে, মন খারাপ করে, অভিমান করে, অভিমান ভুলে আবারো বারেবার একই আব্দার করে। কি করে বোঝাই তাকে আমি অপারগ। আর যুগ আগের মত নাই,আমাদেরকে প্রতিনিয়ত দৌড়াতে হয়, বাচ্চাদের,স্কুল,টিউশনি,আমাদের চাকরী সব সামলে বেড়াতে বের হওয়াটা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। তা বলে বাবা মাকে দেখতে ইচ্ছে হয়না তা কিন্তু নয়। আবেগ দিয়ে তো আর দুনিয়া চলেনা। বিয়ের পর প্রথম প্রথম ছয় মাসে একবার আসতাম, রিনি হবার পর সেটা বছরে একবার হল, আর রাইয়ানকে স্কুলে দেবার পর সেটাও সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠেনা। আগে বাবার বাড়ীতে বেড়াতে আসাটাই ছিল অবসর। এখন আর সৈকত মানে আমার স্বামী শ্বশুর বাড়ীতে এসে ঘর বন্দি হয়ে বসে থাকতে চায়না। সারাটা বছর কত পরিশ্রম করে ওর ওতো একটু বিনোদন চাই। তাই গত দু বছর ধরে সুযোগ পেলে একটু আধটু এদিক সেদিক ঘুরতে বের হই। কিন্তু আমার মায়ের সেসব মাথায় ঢুকেনা, ঢুকবে কিভাবে পয়ঁত্রিশ টা বছরতো ঐ চুলার পাশেই কেটে গেল। ঘর হতে বের না হলে বুঝবে কিভাবে দুনিয়াটা চলছে কিভাবে।

বাবাকে বোঝানো সহজ। বাবারা এত আবেগপ্রবন হয় না। অনুরোধ করে বটে তবে অভিমান করেনা, যুক্তি দেখায় কিন্তু আমার যুক্তি ফেলেনা। সবটা শুনে বিজ্ঞের মত চুপ করে থাকে। সন্তানেরা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এটাই বা কম কিসে। আসুক না হয় দুদিন পর.........

খাবার টেবিলে বসে আমার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। মা রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড় ঘন্ট, চিংড়ি ভর্তা, কচুর লতি, কই মাছ ভাজি, কলিজা ভুনা,টমেটো দিয়ে টেংরা মাছের ঝোল কি রাঁধেনি। তার পরও আমার মনে হল মা তো কিছুই রাঁধেনি। মা তো মুরগীর মাংসই রান্না করেনি। আমার বাচ্চারা এখন কি দিয়ে খাবে। মায়েরা এত স্বার্থপর হয় কিভাবে? শুধু নিজের মেয়ের পছন্দের খাবার গুলাই রান্না করল, আমার বাচ্চা দুটোর কথা ভাবলনা।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মা হয়তবা শঙ্কা অনুভব করল, তাই খুব হেসে হেসে বলল, দেখ দেখ সব তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছি। আমি সব লিস্ট করে রেখেছি রোজ কয়েক পদ করে সব খাওয়াব তোকে,কত দিন পর এলি.......

আমি বিরক্ত হলাম মায়ের এসব আদিখ্যেতায়। স্বার্থপরের মত আমার মাথায়ও শুধু আমার ছেলেমেয়ের কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি মিন্টুর মাকে গলা ছেড়ে ডাক দিয়ে বললাম, মিন্টুর মা দুইটা ডিম ভাজি করতো।

মা বোকার মত তাকিয়ে রইল।

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম, আমার বাচ্চারা কি দিয়ে খাবে মা? তুমি জানোনা ওরা রোজ চিকেন ছাড়া ভাত খায়না।

মা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বলে, আমি তো জানি.....

আমি জানি, মা জানেনা যে ওরা চিকেন ছাড়া ভাত খেতে চায়না। অবশ্য জানবেই বা কিভাবে, মায়ের তো জানারই সুযোগ হয়না কারন ঐ যে কত দিন বাদে এলাম।

সন্ধ্যা নাগাদ ওদের বাবা ফোন দিল। বাচ্চা দুটো নারিকেলের নাড়ু, পুলি পিঠা, কদবেল মাখা, তালের শাসের কথা বেমালুম না তুলে বলল কিনা এখানে প্রচুর মশা, মশা ওদেরকে নাকি খেয়ে ফেলছে। ওরা যে এত কিছু খেল,নানু বাড়ীর এত এত আদর পেল সেসব বলল নাতো। অথচ মা সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ঘরে কয়েল ধরিয়েছে।

সৈকত বাচ্চাদের সাথে কথা শেষে আমাকে গম্ভীর গলায় বলল, দেখ মায়ের আদরে আবেগে অন্ধ হয়ে আমার বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে ভুলনা যেন। সামনে ওদের পরীক্ষা, অসুখ বিসুখ যেন না বাঁধায়।

আমি আশ্বস্ত করি বটে তবে এখানকার পরিবেশ দেখে আমার উৎকন্ঠা হয়।

রাতের বেলায় বাচ্চাদের ছটফটানিতে আমার ঘুম হয়না। হবে কি করে এত গরম। আমার বাচ্চারা তো এসিতে থেকে অভ্যস্ত তাই এখানকার সবার মত ওরা বিছানায়ায় শুয়েই চোখ বুজতে পারছেনা৷ আমি এপাশ ওপাশ করে পানি খেতে উঠি। দেখি মায়ের ঘরে আলো জ্বলছে। আমি আস্তে করে দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দেই। মা বিছানায় পা মেলে দিয়ে বসে আছে আর হাত দিয়ে পা টিপছে, মায়ের মুখটা যন্ত্রনায় কুঁচকে আছে।

আমি আস্তে করে কাছে গিয়ে বলি,মা তুমি ঠিক আছ?

মা চমকে ওঠে,কিরে ঘুমোসনি এখনো?

আমি বলি, তোমার কি হয়েছে?

মা ম্লান হেসে বলে,ঐ বাতের ব্যাথাটা....
আমি ধমক দিয়ে বলি,কে বলেছে এত কিছু করতে তোমাকে? আমরা কি শহরে না খেয়ে থাকি?

মা হেসে ফেলে এবার, আমি কি তাই বলেছি? এত দিন বাদে এলি তোরা আর সারা বছরতো আমার কাজ নাই শুয়ে বসে আর কত, এই তোরা এলি বলেই না শরীরটায় একটু নাড়াচাড়া পড়ল.....

কত করে বলি ঢাকায় আস ডাক্তার দেখাও,কই আস তুমি? আমি এবার অভিমান করি।

তোরা কত ব্যস্ত থাকিস আমরা গিয়ে আর তোদের ব্যস্ততা বাড়াতে চাইনারে, এই তো বেশ আছি নবীন ডাক্তার বেশ ভাল ঔষধ দেয় জানিস, দুদিন ঔষধ খেলেই সব কমে যাবে।

আমাদের এমন টুকটুক করে গল্প চলতেই থাকে যেন রাতটা থমকে যায় ......

সকাল হতেই রাইয়ান কাশি দিতে থাকে। বাবা ওকে মধু তুলশীর পাতা খাইয়ে দেয়,মা বুকে সরীষার তেল ঘষে। ব্যস্ত হয়ে ওঠে সকলে। মা যেন বিনে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যায়। এই করছে,সেই আনছে অস্থির হয়ে ওঠে একদম। আমি ছেলেকে নিয়ে উৎকন্ঠার মধ্য দিয়েও দেখি রাতের বেলায় পায়ের ব্যাথায় ঘুমতো না পারা মানুষটাকে যেন নিজেকে ভুলে বসে আছে।

কিন্তু বিকেল বেলায় রিনির মুখে রাইয়ানের অসুস্থতার কথা শুনে সৈকত যখন আমাকে দু কথা শোনাল তখন আমার মেজাজটা চড়ে গেল।

মাকে বলি, মা কেন ডাক আমাদেরকে দু দিন পর পর বলত। এত গরমে মানুষ বাঁচে? ছেলেটার গরমে ঘাম বসে ঠান্ডা লেগে গেল। এখন যদি নিউমনিয়া হয়ে যায়? আমি যে কেন তোমার মায়া কান্না শুনে লাফাতে লাফাতে চলে এলাম। আমার হয়েছে যত জ্বালা এসেছি দুটোদিন বাবার বাড়িতে এখনই অসুখ করতে হবে এখনই........

দুই রাত দুইদিন থাকার পর আমি ফেরার প্রস্তুতি নিলাম, আসলে ফিরতে বাধ্য হলাম। বললামনা মায়েরা স্বার্থপর হয় তাই আমিও আমার বাবা মায়ের কথা না ভেবে মা হিসেবে সন্তানদের কথা ভেবেই আমার বাবার বিমর্ষ মুখ, মায়ের নির্বাক ভেজা চোখ উপেক্ষা করে চলে এলাম। রাত আটটায় আমার ট্রেন ছেড়ে গেল আমার প্রাণের ভূমি হতে.......…

২.
আমি ডিপ ফ্রিজটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকি। বায়ান্ন বছর বয়সি আমার সোনার সংসারে কি নেই। এসি,বাড়ী,গাড়ী,গিজার.... সব আছে সব। এই যে ফ্রিজ ভর্তি ছ মাস ধরে রাখা ইঁচড়, কাঁচা আম, গত সপ্তাহে রাখা কলার মোচা........ এসব কিছুও তোলা আছে আমার ছেলে মেয়ের জন্য। মেয়েটা আট বছর হল দেশের বাইরে প্রথম প্রথম দুয়েক বছর পর পর এলেও গত চার বছর ধরে আসার সুযোগ হয়না, এই ডিসেম্বর এ আসার কথা ছিল কি যেন ঝামেলা আছে বলল আসতে পারলনা, এর পর ফেব্রুয়ারিতে আসবে বলল সেটাও হলনা বাচ্চাদের স্কুল আছেতো। তাছাড়া এখানে আসলেই ওর বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ে এখানকার আবহাওয়া নাকি স্যুট করেনা। এদেশে এত ধুলা,এত গরম, এত আওয়াজ, নোংরা পরিবেশ মানুষ থাকে এখানে এই বলে মেয়েটা দেশে আসায় অনাগ্রহ দেখায়। তা বলে কি আমিতো মা তাই ওরা আসবে বলেই রোজ একটু একটু করে সব জমিয়ে যাচ্ছি। কখন আবার হুট করে ফোন করে বলে, মা সামনের মাসেই আসছি কিন্তু।

ছেলেটাতো গিয়েছে এই তিন বছর হয়ে গেল। কি জানি সব সব কাগজপত্র ঠিক করে তবেই আসতে পারবে। গেলেই কি আর আসা যায়, কত নিয়ম কানুন আছেনা।

তবুও আমি কান খাড়া করে রাখি এই বুঝি কল এল,ফোনে ওদের সাথে কথা বলার সময় উৎসুক হয়ে থাকি এই বুঝি বলল, খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে মা।

কিন্তু না সময় বাড়তে থাকে,আমার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে আর ক্ষীণ হতে থাকে আমার আশা। রাত গভীর হলে আমার অস্থিরতা বাড়ে। মনে হয় এই বুঝি রাইয়ান ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করল। মেয়েটা বুঝি আলো না নিভিয়েই বইয়ে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ওদের রুমের দিকে এগিয়ে যাই৷ অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে নিরাশ হয়ে ফিরে আসি। শেষ রাতে আমার সন্তানেরা ঐ দূর দেশে নিশ্চিতে ঘুমচ্ছে এই সান্ত্বনা নিয়ে আমিও ঘুমে ঢলে পড়ি।

আমার মা যেদিন মারা যায় সেদিন প্রচুর গরম ছিল, জৈষ্ঠ্য মাসের গরম। আমি সেই গরম উপেক্ষা করে,আমার ছেলের এস. এস. সি পরীক্ষা চলছে ভুলে আমি অফিস ফেলে ছুটে যাই সেই সবুজ, শীতল ছোট্ট গ্রামে। তখন আর আমার গরম বোধ হয়না, আমি ছেলেমেয়ে বাড়িতে কি করছে কি খাচ্ছে সেসব ভেবে উদ্বিগ্ন হইনা। আমি আর সৈকতের কটু কথা শোনার ভয় করিনা।

সপ্তাহ খানেক বাদে বাড়ীতে ফিরে দেখি সব চলছে দিব্বি আমাকে ছাড়া, কৈ কোথাও কিছু আটকায় নিতো,কিছু কম পড়ে নিতো, কিছু থেমে যায় নিতো। তবে কি এত গুলো বছর আমিই নিজেকে নিজে নানান অজুহাতে হাতে পায়ে শেকল পড়িয়ে রেখেছিলাম যে শেকল ছিন্ন করে আমি এত মায়ার টান বুঝতে পারতাম না, হাসি মুখে নিরুদ্বেগে সেই শীতলতা অনুভব করতে পারতামনা,পারতামনা বলতে, যত ব্যস্ততাই থাকুক তোমরা ডেকেছ আমি না এসে পারি বল মা?

কিন্তু না আমার জন্য আর কেউ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেনা, অবুঝের মত বারবার করে আমাকে দেখার আকুতি জানায় না, আমার ফোনে আর অবহেলিত সেই নাম্বারটা থেকে কল আসেনা। আমার অতি ব্যস্ত জীবনটায় যেন আর ব্যস্ততা অনুভূত হয়না।

আমি প্রতিবছর বাবা মায়ের মৃত্যু বার্ষিকীতে বাড়ীতে আসি। চুন খসে পড়া নিস্প্রাণ ঘরটাতে বসে থাকি। সে ঘরের প্রতিটি আসবাবে আমার শৈশব মোড়ানো, আমার বাবার কষ্টার্জিত অর্থের ইতিহাস লুকানো আর আমার মায়াবী মায়ের মায়া জড়ানো। জনমানবহীন এঘর আমাকে সঙ্গ দেয়, আমার বিবেককে প্রতিনিয়ত নাড়া দেয় আমি অসহায়ত্ব অনুভব করি, অনুতাপ করি, অনুশোচনায় ভুগি। নিজেকে এ শেষ বেলায় এসে বড্ড স্বার্থপর সন্তান মনে হয়।

আচ্ছা রিনি রাইয়ানেরও কি কখনো এমন অনুভুতি হবে ওরা ও কি আমার মত আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে অনুভব করতে চাইবে? নাকি ঐ আমার পা না বাড়ানো এক অচেনা জগতেই বিলীন হয়ে রইবে?

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)